মঙ্গল বনাম আনন্দ; শব্দের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ভবিষ্যৎ।
কৃষ্ণ কুমার শর্মা, প্রজ্ঞা নিউজ ডেস্ক:
ভূমিকা: বাংলা নববর্ষ কেবল একটি দিন নয়—এটি বাঙালিরসাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের প্রতীক। এটি একটি ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠাউল্টানো নয়, বরং ইতিহাস, ঐতিহ্য, চেতনা ও নাগরিক মূল্যবোধের সঙ্গেযুক্ত এক উৎসব। সেই উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’—যাশুধু একটি শোভাযাত্রা নয়, এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বাহক।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব—‘মঙ্গল’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামকরণের প্রস্তাব—বাঙালি সমাজকে এক নতুন বিতর্কে ফেলেছে। একে কেউ দেখছেনধর্মনিরপেক্ষতার খাতিরে একটি প্রস্তাব হিসেবে, আবার কেউ বলছেন—এটি একটি সুপরিকল্পিত সাংস্কৃতিক অপচেষ্টা। এই প্রবন্ধে আমরা এইবিতর্কের গভীরে যাবো—ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিকতা, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বিশ্লেষণ সহ।
ইতিহাস: নববর্ষের ‘মঙ্গল’ কোথা থেকে এল?
বাংলা নববর্ষের উৎপত্তি মূলত মুঘলআমলে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে ফসলিসন হিসেবে। তবে একে সাংস্কৃতিক রূপদিয়েছে এ দেশের কৃষিভিত্তিক সমাজ, যারাবৈশাখকে নতুন সূচনার মাস হিসেবেবিবেচনা করেছে। চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখেরশুরুতে বিভিন্ন রকম পালা-পার্বণ, পিঠা উৎসব, গানে-নৃত্যে নববর্ষকেউদযাপন করতো সাধারণ মানুষ।
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র সূচনা হয় ১৯৮৯ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরচারুকলা অনুষদের উদ্যোগে। তখনকার লক্ষ্য ছিল—স্বৈরাচারবিরোধীআন্দোলনের সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। শোভাযাত্রাটি হয়ে ওঠে গণমানুষেরসংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক। ‘মঙ্গল’ শব্দটি এখানে শুধু ধর্মীয়অর্থে নয়, বরং শুভ, কল্যাণ, ঐক্য ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃতহয়েছে।
‘মঙ্গল’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ
‘মঙ্গল’ শব্দটির মূল সংস্কৃত ধাতু "মং" অর্থাৎ শুভ বা কল্যাণ। বাংলাভাষায় ‘মঙ্গল’ শব্দটি বহুল প্রচলিত। মঙ্গলকাব্য, মঙ্গলগান, মঙ্গলাচরণ, মঙ্গল প্রদীপ, মঙ্গল কামনা—এসব কোনো বিশেষ ধর্মেরমধ্যে আবদ্ধ নয়। বরং এই শব্দটি একটি সংস্কৃতি-সাংস্কৃতিক বোধেরঅংশ, যা বাঙালির দৈনন্দিন জীবন ও সাহিত্যের গভীরে প্রোথিত।
অন্যদিকে, ‘আনন্দ’ শব্দটিও শুভ, হর্ষ ও সুখবোধের প্রতীক। কিন্তুএখানে প্রশ্ন হলো—কেন এতদিন পর, কেন এই পরিবর্তনের প্রস্তাব? শব্দের শুধু ব্যুৎপত্তি নয়, রাজনৈতিক সময়চেতনার ভেতরেও এর ব্যাখ্যাপ্রয়োজন।
বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু: শব্দ নাকি আদর্শ?
‘মঙ্গল’ শব্দটিকে অনেকেই হিন্দু ধর্মীয় পরিভাষা হিসেবে চিহ্নিতকরছেন, যদিও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ইতিহাসে দেখা গেছে—শাসকশ্রেণির হাত ধরে বারবার জনগণের সংস্কৃতিকে পুনর্লিখনের চেষ্টাহয়েছে। কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে, কখনো জাতীয় ঐক্যের নামে।
তবে একটি শব্দের পরিবর্তন শুধু নামের পরিবর্তন নয়, বরং একটিআদর্শচ্যুতি। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরইতিহাস, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও প্রতিবাদী চেতনার অংশ। এর পরিবর্তনমানে সেই ইতিহাসকে মুছে ফেলা।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: ইউনেস্কো ও আমাদের গৌরব
২০১৬ সালে ইউনেস্কো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে "Intangible Cultural Heritage of Humanity" হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এটি কেবল চারুকলারছাত্র-শিক্ষকদের কৃতিত্ব নয়, এটি গোটা জাতির। ইউনেস্কোতে পেশ করানথিতে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র ব্যাখ্যায় কোথাও ধর্মীয় সংশ্লেষ নয়, বরংসামাজিক ঐক্য, পরিবেশ সচেতনতা, নারীর ক্ষমতায়ন, এবং শিল্পচর্চারকথা বলা হয়েছে।
এই নাম পরিবর্তনের চেষ্টা হলে সেই স্বীকৃতির ভবিষ্যৎ কি? একই ভাবে, কালক্রমে বসন্ত উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তি, বাউল গান—সবই ধর্মের ছাঁকনিদিয়ে বিচার হতে পারে।
সাংস্কৃতিক রাজনীতি: শব্দ যখন অস্ত্র
বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে—ভাষা ও সংস্কৃতিকে কখনোই একান্তভাবেসাংস্কৃতিক বলে ভাবা যায় না। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯সালের গণঅভ্যুত্থান, কিংবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ—সবখানেই ভাষাও সংস্কৃতির ছিল এক বিপ্লবী ভূমিকা।
আজকের ‘মঙ্গল’ বনাম ‘আনন্দ’ বিতর্ক সেই ধারাবাহিকতারই একটিনতুন পর্ব। এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে—একটি দার্শনিক বিভাজন। একটিপক্ষ ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধনে বিশ্বাসী, আরেক পক্ষ অতীতেরব্যাখ্যাকে সংস্কার করার নামে সংস্কৃতির শিকড় উপড়ে ফেলতে চায়।
সংবাদমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া: মতভেদ ও মেরুকরণ
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশন টক-শো, এবং অনলাইন মিডিয়ায়এই বিতর্ক উঠে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে। কিছু সংবাদমাধ্যম একেধর্মনিরপেক্ষতার অংশ হিসেবে দেখাচ্ছে, আবার কিছু বলছে—এটিরাজনৈতিক বিভ্রান্তি তৈরি করার কৌশল।
তরুণ সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন—“শুধু শব্দ নয়, আমরাআমাদের চেতনার রক্ষার্থে লড়ছি।” অন্যদিকে কিছু ধার্মিক গোষ্ঠী দাবিকরছে—‘মঙ্গল’ শব্দে তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে।
সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিশিষ্টজনদের মতামত
চারুকলার অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী আশরাফ বলেন, “মঙ্গল শব্দকেবাদ দিলে শুধু একটি নাম নয়, আমরা একটি আন্দোলনকেই অস্বীকারকরবো।”
কবি জলি মোহাম্মদ লিখেছেন, “মঙ্গল মানেই হিন্দু নয়। মঙ্গল মানেপ্রার্থনা, শুভ কামনা, সম্মিলন।”
সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’, ‘সংস্কৃতি পরিষদ’, ‘বাংলাদেশ গ্রুপথিয়েটার ফেডারেশন’-এর তরফ থেকেও বিবৃতি এসেছে—নামেরপরিবর্তন ঐতিহ্যবিরোধী এবং বিভাজনমূলক।
তরুণ প্রজন্মের জবাব
সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি সরব তরুণ প্রজন্ম। হ্যাশট্যাগ‘#মঙ্গল_আমার_গর্ব’ ট্রেন্ড করেছে টুইটারে। অনেকেই তাদের শৈশবেরস্মৃতি জুড়ে থাকা মঙ্গল শোভাযাত্রার ছবি ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন।তারা বলছে—‘আনন্দ’ তো মঙ্গলেই নিহিত। এর নাম বদলে দিলেআমরা ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো।
ধর্মনিরপেক্ষতা কি শব্দ পাল্টে আসে?
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে হলো—সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, না যেকোনও একটি ধর্মকে খুশি করতে বাকিদের সংস্কৃতি মুছে ফেলা। যদি‘মঙ্গল’ শব্দ হিন্দুদের একার হয়, তবে রোজার ঈদ, কোরবানির ঈদ কিমুসলিমদের একার নয়? তবু এগুলো সকলের উৎসব হিসেবে বিবেচিতহয়।
আসলে প্রশ্ন হলো—একটি নাম কি কারো ধর্ম বিশ্বাসকে সত্যিই আঘাতকরে, না কি সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি অনাহুত প্রয়াস?
ভবিষ্যতের জন্য করণীয়: ব্যাখ্যার সংস্কৃতি গড়ি
আমরা যদি একটি শব্দকে নিয়ে এত বিভক্ত হয়ে পড়ি, তাহলে আমাদেরআরও অনেক ঐতিহ্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তাই পরিবর্তনের পরিবর্তেদরকার ব্যাখ্যার সংস্কৃতি।
প্রতিটি স্কুলে, মিউজিয়ামে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’রঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য তুলে ধরা দরকার। সামাজিকপাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এর মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরপ্রেক্ষাপট।
উপসংহার: মঙ্গল থাকবে, তাতেই আনন্দ
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেবল প্রযুক্তি বা অর্থনীতিতে নয়, বরং সংস্কৃতি ওচেতনায় নিহিত। আমরা যদি আমাদের ভাষা, শব্দ, উৎসব ও রীতিকেসম্মান না করি, তবে আমরা এক শিকড়হীন জাতিতে পরিণত হবো।
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ শুধু চারুকলার ক্যানভাসে আঁকা কিছু মুখোশেরবহর নয়, এটি বাঙালির চেতনার এক প্রবাহমান নদী। সেই নদীর নামপাল্টে দিলে তার উৎস, ধারা, এবং গন্তব্য—সবই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
তাই আসুন, ঐতিহ্যের নামে নয়, সচেতনতার নামে এর রক্ষণাবেক্ষণকরি। 'মঙ্গল'-এর মধ্যেই আমাদের আনন্দ, আর সেই আনন্দেইআমাদের মঙ্গল।
লেখক: কৃষ্ণ কুমার শর্মা, এফসিএস | বিশেষ প্রতিবেদক এবং কলামিস্ট